এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, সুন্দরবন থেকে ফিরে: বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন—শুধু প্রকৃতির দান নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও ছিল এক সাহসী রণক্ষেত্র। ১৯৭১ সালের ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে এই বনাঞ্চল ও তার নদ-নদীগুলো লড়াইয়ে হয়ে উঠেছিল গোপন ঘাঁটি, সুরক্ষা দেয়াল এবং জীবন বাঁচানোর প্রধান পথ। রণাঙ্গনে নদী ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মিত্র বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা সুন্দরবনের বলেশ্বর, পশুর, শেলা, শিবসা, হরিণঘাটা, ভোলা, রায়মঙ্গল, মালঞ্চসহ অসংখ্য নদী হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ, পলায়ন ও পুনর্গঠনের কৌশলগত মাধ্যম। মুক্তিবাহিনী গেরিলা কৌশলে এই নদীপথ ব্যবহার করে সফলভাবে শত্রুর উপর হামলা চালাতো এবং নিরাপদে সরে যেতো। সুন্দরবন সাব-সেক্টর—রণাঙ্গনের ভিতরে এক দুর্গ ৯ নম্বর সেক্টরের অংশ হিসেবে সুন্দরবন হয়ে ওঠে ‘সুন্দরবন সাব-সেক্টর’। শরণখোলা রেঞ্জের আড়াইবাঁকী এলাকায় ছিল ক্যাম্প হেডকোয়ার্টার। মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় গুরুত্বপূর্ণ গেরিলা ক্যাম্প, যেখান থেকে পরিচালিত হয় একাধিক অপারেশন। শেলা নদীতে রুদ্ধশ্বাস গেরিলা হামলা ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে শেলা নদী পথে পাকিস্তানি সেনাদের গানবোট ও স্টিমারে সরবরাহ বন্ধ করতে মুক্তিযোদ্ধারা গাছের ডালে উঠে বেঁধে নেয় গুলি চালায়। এতে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। যুদ্ধটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও কৌশলের এক অনন্য নিদর্শন। অপারেশন জ্যাকপট ও নৌ-কমান্ডোদের অবদান। ১৪ আগস্ট হিরণ পয়েন্টে অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন ১৪ জন নৌ-কমান্ডো। যদিও মূল লক্ষ্যে আঘাত হানা সম্ভব হয়নি, তারা সফলভাবে বন বিভাগের একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেন এবং পরে চালনা বন্দরের অপারেশনে অংশ নেন। নদীপথে দেশত্যাগ ও মানবিক সংকট রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারে উপকূলবাসী হাজার হাজার মানুষ সুন্দরবনের নদীপথে দেশত্যাগ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেন। কচা, বলেশ্বর, শেলা, পশুর, মালঞ্চ নদী হয়ে তারা সীমান্তে পৌঁছাতেন। মুক্তিযোদ্ধা মাঝির গল্প: আবুল হাশেম হাওলাদার জোলাগাতীর মুক্তিযোদ্ধা ও মাঝি আবুল হাশেম বলেন—“ঘোর অন্ধকারে, ঝড়-তুফানে গানবোটের মাঝখান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা চালিয়ে নিয়ে এসেছিলাম আমি। পাকিস্তানি গুলিতে হাতের আঙুল হারালেও হাল ছাড়িনি।” প্রকৃতি ও মানুষ—একসাথে লড়েছিল স্বাধীনতার জন্য সুন্দরবনের ইতিহাস শুধু গাছপালা বা বন্যপ্রাণী দিয়ে নয়, একাত্তরের লড়াই দিয়ে আঁকা। এই বনভূমি দিয়েছে আশ্রয়, সুরক্ষা ও কৌশলগত সুবিধা। নদীগুলো শুধু পানির ধারা নয়, ছিল বেঁচে থাকার সেতু।
Leave a Reply