শেখ সাইফুল ইসলাম কবির, সুন্দরবন থেকে ফিরে:বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৭৫ সালের মধ্যে বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার হারিয়ে যেতে পারে সুন্দরবন থেকে — এমন আশঙ্কাজনক তথ্য উঠে এসেছে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনগুলোতে। অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বনের ভূমি নিম্নস্তরে থাকার ফলে বাঘের আবাসস্থল হারিয়ে যাচ্ছে। গবেষণার চিত্র ভয়াবহ ২০৭০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অংশে বাঘের জন্য উপযুক্ত আবাস থাকবে না। ২০৫০-৭৫ সালের মধ্যে ১১.৩% পর্যন্ত আবাস হারিয়ে যেতে পারে। বর্তমান গড় হারে গ্লোবাল ওয়ার্মিং চলতে থাকলে ২০৪০ সালেই ১.৫°C তাপমাত্রা বাড়বে। সুন্দরবনের বাঘ সংখ্যা: ক্রমশ নিম্নমুখী বছর বাঘের সংখ্যা ১৯৭১ ৩২০টি ২০০৪ ৪৪০টি (পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে) ২০১৫ ১০৬টি (ক্যামেরা ট্র্যাপে) ২০২৪ ১২৫টি (সর্বশেষ শুমারি) গত ১৫ বছরে বাঘ কমেছে প্রায় ৮৬%। তবে সাম্প্রতিক গণনায় কিছুটা অগ্রগতি দেখা গেছে। বাঘ না থাকলে সুন্দরবন থাকবে না বাঘ শুধু শিকারী নয়, এটি সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের নিয়ন্ত্রক প্রাণী। বাঘের অনুপস্থিতিতে বন ধীরে ধীরে ভারসাম্য হারাবে। এই বন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও পরিবেশগত দুর্যোগ থেকে রক্ষায় এক অন্যতম প্রাকৃতিক ঢাল। বাঁচানোর উদ্যোগ বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাঘ সংরক্ষণ নিয়ে সমঝোতা চুক্তি ও প্রটোকল সই। সুন্দরবনের ৫২% এলাকাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা। টাইগার কোঅর্ডিনেশন কমিটি ও টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান গৃহীত।বর্তমানে বাঘ পৃথিবীর মাত্র ১২টি দেশে টিকে আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়া। উলেস্নখ্য, বাংলাদেশ ও ভারতের চার হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়ে সুন্দরবন। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ কয়েকশ’ প্রজাতির প্রাণীর আবাস বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বনে। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এই বন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু সুন্দরবনের ৭০ শতাংশ ভূমি সমুদ্রের উপরিভাগের মাত্র কয়েক ফুট ওপরে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৭০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বাঘের জন্য কোনো উপযুক্ত জায়গা থাকবে না। সাম্প্রতিক অন্য এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের বিপন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রায় অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাঘের আবাসস্থল তলিয়ে যাবে। গবেষণা অনুযায়ী, ২০৫০ থেকে ২০৭৫সালের মধ্যে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ আবাসস্থল হারিয়ে যাবে। বর্তমান হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন চলতে থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের যৌথ এক গবেষণা প্রকাশ করেছে সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট। ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের বিপন্ন বাঘ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, ক্রমাগত সাগরের পানি বাড়ার কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। গবেষণা পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, আগামী ৫০ বছরে, অর্থাৎ ২০৭৫ সালের মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বনবিভাগের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মোট সাতবার বাঘশুমারি হয়েছে। শুমারি অনুসারে ১৯৭১ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৩২০টি, ১৯৭৫ সালে ৩৫০টি, ১৯৮০ সালে ৪৩০টি, ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি, ১৯৯৩ সালে ৩৬২টি, ২০০৪ সালে ৪৪০টি এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। সুন্দরবনে গত ১৫ বছরে গড়ে বাঘ কমেছে ৮৬ শতাংশ ২০২৪ সালের বাঘ গণনায় ১১ টি বাঘ বেড়ে বর্তমান সুন্দরবনে ১২৫টি বাঘ রয়েছে এর আগের গণনায় ছিল ১১৪ টি বাঘ। সুন্দরবন পৃথিবীর পাঁচটি বৃহৎ বাঘের আবাসস্থলের মধ্যে একটি। বাঘ এই বনের প্রাকৃতিক পাহারাদার। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাঘ সুন্দরবন প্রতিবেশব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী প্রাণী। পরিবেশের ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিবেশব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সুন্দরবনে বাঘের উপস্থিতি অপরিহার্য। ২০১৫ সালে সুন্দরবনে বাঘের উপর একটি জরিপ সম্পন্ন হয়। এতে সুন্দরবনে ১০৬টি বাঘ থাকার তথ্য উঠে আসে। ২০০৪ সালে পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে ৪৪০টি বাঘ থাকার কথা বলা হয়েছিল। জলবায়ুর প্রভাব ছাড়াও বন উজাড় ও অবৈধ শিকারের ফলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার এখন বিশ্বে ‘বিপদাপন্ন’ প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানে সারাবিশ্বে প্রকৃতিতে বিদ্যমান বাঘের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার ৮৯০টি। বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাঘের সংখ্যা দ্রম্নত কমে যাওয়ার এই প্রবণতা চলমান থাকলে পৃথিবী থেকে বাঘ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাঘের আবাসস্থল উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বর্তমানে সুন্দরবনের প্রায় ৫২ শতাংশ এলাকা অভয়ারণ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উভয় সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ, বাঘ ও শিকারি প্রাণী পাচার বন্ধ, দক্ষতা বৃদ্ধি, মনিটরিং ইত্যাদির জন্য একটি সমঝোতা স্মারক এবং একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে। সুন্দরবনের বাঘ রক্ষার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে টাইগার কোঅর্ডিনেশন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাঘ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন পস্ন্যান প্রণয়ন করেছে।গত ১৫ বছরে বাঘ কমেছে প্রায় ৮৬%। তবে সাম্প্রতিক গণনায় কিছুটা অগ্রগতি দেখা গেছে। বাঘ না থাকলে সুন্দরবন থাকবে না
Leave a Reply