যশোর জেলা প্রতিনিধি: যশোরের অভয়নগর উপজেলার শিল্প বন্দর নগরী হিসাবে খ্যাত নওয়াপাড়া পৌরসভাসহ রাজঘাট, তালতলা, সর্দার মিল, ভাঙ্গাগেট, মহাকাল, রথখোলা, চেঙ্গুটিয়া, বুড়োরদোকান, উড়োতলা, চাঁপাতলা, প্রেমবাগ, নগরঘাট, ঘোপেরঘাট, কজমিল, চলিশিয়া, পায়রা, আমডাঙ্গা, ধোপাদী, লক্ষীপুর, মশরহাটি, দেয়াপাড়া, শংকরপাশাসহ আশেপাশের এলাকার কিছু অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা ওইসব এলাকার পুকুর, ডোবা নালা, কৃষি আবাদি জমি ধ্বংস করে অবৈধভাবে কয়লা ড্যাম্পিং করছে। যে কারণে চরম বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। উপজেলার মহাকাল গ্রামের মাসুদ সরদার নামে একজন জানান, পার্শ্ববর্তী ভৈরব নদের তীরে মল্লিক বাড়ীর ঘাট, তরফদার পাড়ার ঘাটে ও ঘোপেরঘাট কালিবাড়ী ঘাটে দেদারছে চলছে কয়লা- বালুর ড্যাম্পিং এর মহোৎসব। আশে পাশের জনবসতিতে সেখান থেকে উড়ে আসা কয়লার ধোঁয়া ও বালুর ধুলায় সৃষ্টি হচ্ছে কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থা। প্রশাসন ও আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে বসতবাড়ি ঘিরে কয়লা-বালুর ড্যাম্পিং করায় অনেকে বসতভিটা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। নানা কারণে ভুক্তভোগীরা হয়রানিসহ নাজেহাল হয়ে পড়ছে। যশোর খুলনা মহাসড়কের চেঙ্গুটিয়া থেকে রাজঘাট পর্যন্ত প্রায় ১২ কি.মি পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে, রেল লাইনের পাশে, পাওয়ার ষ্টেশনের গায়ে, নদীর ধারে, কৃষি আবাদি জমি, পুকুর বন্ধ করে ও আবাসিক জনবসতি এলাকায় এ সকল কয়লা-বালুর ড্যাম্পিং করা হচ্ছে। আর এই কয়লার বিষাক্ত ধোয়া ও দূর্গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে থাকছে পুরো এলাকা। নওয়াপাড়া পৌরসভার মহাকাল, চেঙ্গুটিয়া এলাকায় কয়লার মজুদ সবচেয়ে বেশি। মহাকাল গ্রামের আরও এক বাসিন্দা শফিকুর রহমান জানান, এখানে আমার তিন প্রজন্মের বসবাস। কয়লার কারণে বসতবাড়িতে বসবাস দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। ঘর-দরজা, আসবাবপত্র, পোশাক পরিচ্ছদ কয়লা- বালুর ধুলায় সয়লাব। এমনকি ভাত, তরিতরকারির সাথে খেতে হচ্ছে কলয়ার ধুলা। সরেজমিনে দেখা যায়, গাছপালা, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ী সর্বত্রই কয়লা- বালুর ছাপ। উপজেলার একাধিক মানুষ অভিযোগ করেন কয়লা-বালুর ডিপো সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন সময় স্মারকলিপি, মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করা হলেও পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা কোন কর্তৃপক্ষই এযাবতকাল ব্যবস্থা নেয়নি। তারা আরও বলেন, কয়লা-বালুর বিষাক্ত ধুলা ও ধোয়ায় তাদের পরিবারের অনেকেই ফুসফুসজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে। সরেজমিন দেখা যায়, রাজঘাট থেকে প্রেমবাগ পর্যন্ত তালতলা, নওয়াপাড়া বাজারের আশপাশ, গুয়াখোলা, কলাতলা, পাঁচকবর, মশরহাটি, ভাঙ্গাগেট, মহাকাল, বালিয়াডাঙ্গা, চেঙ্গুটিয়া, চাঁপাতলা এলাকায় দেড় শতাধিক কয়লার ডিপো গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর প্রায় ৯/১০ লাখ টন কয়লা নওয়াপাড়ার বিভিন্ন ঘাটে জাহাজে করে আসে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ২০-২২টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এই বিপুল পরিমাণ কয়লা নওয়াপাড়ায় আমদানি করে। পৌরসভার আবাসিক এলাকা ও গ্রামের মধ্যে কয়লা রাখায় দিন রাত সবসময়ই বাতাসে কয়লার ধুলা ও ধোয়া ছড়াচ্ছে। এসব এলাকায় মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শিশু বয়স্কসহ সব বয়সের মানুষ ফুসফুসজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কয়লাবোঝাই কার্গো জাহাজ ও বার্জ (লাইটার জাহাজ) থেকে ফেলা বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে উপজেলা বাসীর স্বপ্নের ভৈরব নদের পানি। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, কয়লার পোড়া দূর্গন্ধে মহাকাল, চেঙ্গুটিয়াসহ আশেপাশের বাতাস বিষময় হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যে কয়লার স্তুপে আগুন ধরে যায়, তাছাড়া কয়লার ধুলা ঢুকছে মসজিদ, মন্দির ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে। আবাসিক এলাকায় কয়লা ড্যাম্পিং ঠেকাতে না পেরে ঘরবাড়ি বিক্রি করে পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে শতাধিক পরিবার। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জনবসতির দেড় কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা ডিপো করা নিষিদ্ধ, জনবসতিপূর্ণ এলাকার বাইরে উচু দেওয়াল দিয়ে ঘিরে কয়লা ড্যাম্পিং করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জনবসতি পূর্ণ আবাসিক এলাকায় করা হচ্ছে পাহাড় সমতুল্য উচু উচু কয়লার ড্যাম্প। জরুরি ভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সরেজমিনে কয়লা-বালুর ড্যাম্পের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে দাবি করেছেন সচেতন মহল ও এলাকাবাসী। এ বিষয়ে অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জয়দেব চক্রবর্তী এর নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার নজরে এসেছে পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ মিজানুর রহমান বলেন, কয়লা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। তিনি আরও বলেন, কয়লার বিষাক্ত ধূলা মানব দেহের নিঃশ্বাসের সাথে প্রবেশ করে ফুসফুস, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদূর্ভাব ঘটায়। করনাকালীন সময় সরকারি কঠোর নির্দেশনার কারণে মুখে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক থাকায় কয়লার বিষক্রিয়া থেকে সাধারণ মানুষ মোটামুটি রক্ষা পেলেও, যারা মাস্ক ব্যবহার করছে না তাদের জন্য কয়লার গ্যাস তাদের স্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি স্বরুপ। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোঃ ইমদাদুল হুক বলেন, বর্তমানে এ বিষয়ে কোন তথ্য হাতে আসেনি। তবে আমরা ওই এলাকায় পরিদর্শনে যাব। কয়লা ড্যাম্পিং বন্ধের জন্য এলাকাবাসীর যশোর খুলনা মহাসড়কে মানববন্ধন ও অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছে যার স্মারকলিপি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দেওয়া হলেও সাময়িক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয় সাধারণ মানুষের দাবি অবিলম্বে আবাসিক এলাকার মধ্য থেকে কয়লা ড্যাম্পিং বন্ধ করে দূষণ বন্ধে কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরিবেশবিদ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা হোক।