লেখক এস এম রমজান আলী: শৈশবের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ মানেই ছিল এক অদ্ভুত হালকা অনুভূতি। বছরের সব চাপ, পড়াশোনার বোঝা, শিক্ষক-অভিভাবকদের কঠোর নজরদারি—সব যেন এক নিমিষে হাওয়া হয়ে যেত। ডিসেম্বর মাসটা তাই ছিল স্বপ্নময়। পরীক্ষার শেষ ঘণ্টার সঙ্গে সঙ্গেই মন ছুটে যেত ছুটির দিনগুলোর দিকে, যেখানে অপেক্ষা করত অবকাশ, আনন্দ আর ঘুরে বেড়ানোর অসংখ্য পরিকল্পনা। আমাদের জন্য ডিসেম্বর মানে ছিল গ্রামে যাওয়া। শহরের ব্যস্ততা আর শব্দের জটলা ছেড়ে গ্রামের শান্তিময় পরিবেশ যেন শরীর ও মন দুটোই নতুন করে সতেজ করে দিত। গ্রামে গেলে ছিল পুকুরে সাঁতার কাটা, বাঁশঝাড়ের নিচে বসে পাতার বাঁশি বাজানো, আর নতুন ধানের গন্ধ মাখা শীতের পিঠার স্বাদ নেওয়া। সকালের কুয়াশায় ঢাকা মাঠে দৌড়ানো, নদীর ধারে বসে আকাশের শূন্যতায় হারিয়ে যাওয়া, কিংবা মাটির ঘরের গায়ে লেপ মুড়িয়ে গল্প শোনা—সবই ছিল জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আমাদের তখনকার শীতকাল ছিল প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্বের সময়। বিকেলগুলোয় গাছের নিচে বসে লাটিম খেলা, চাঁদনি রাতে পুকুরঘাটে বসে গল্প করা, কিংবা শীতের সকালের নরম রোদে দাদা-দাদীর সঙ্গে সময় কাটানো—এসব স্মৃতিগুলো আজও যেন রঙিন ফ্রেমে বাঁধা। এই ছুটিতে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা হওয়া। সারাবছরের দূরত্ব এই কয়েকটা দিনেই যেন দূর হয়ে যেত। বাড়ির বয়স্করা যখন আমাদের জন্য গল্পের ঝুলি খুলে বসতেন, তখন মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাদুকরের সামনে বসে আছি। সন্ধ্যাবেলায় গ্রামে মেলা বসত। সেই মেলার মাটির খেলনা, কাঠের পুতুল আর পাটের দড়ির দোলনায় চড়ার আনন্দ এখনো যেন চোখে ভাসে। ছুটির দিনগুলো যেন অল্প সময়ের মধ্যেই ফুরিয়ে যেত। ফেরার সময় মনটা ভারি হয়ে যেত, তবু পরের বছরের ডিসেম্বরের অপেক্ষা শুরু হয়ে যেত আবার। শৈশবের সেই ডিসেম্বরের ছুটি যেন এক অমূল্য ধন, যার স্মৃতি আজো মনের গভীরে আলোকিত হয়ে থাকে। আজকের ব্যস্ত জীবনে যখন ডিসেম্বর আসে, তখন সেই শৈশবের দিনগুলোর কথা বারবার মনে পড়ে। এই ডিজিটাল যুগে শিশুদের জন্য এমন ছুটির আনন্দ কতটা সম্ভব, জানি না। তবে আমি চাই, আমার সন্তানও যেন এই ডিসেম্বরের মতো কিছু মুহূর্ত নিজের জীবনে সঞ্চয় করতে পারে—যেখানে থাকবে প্রকৃতি, আনন্দ আর নিখাদ স্মৃতির ভান্ডার। আজ যখন নিজের সন্তানকে দেখি, তখন ইচ্ছা হয় সেই দিনগুলো ওর জীবনেও নিয়ে আসতে। কেবল ডিজিটাল স্ক্রিনের সীমাবদ্ধতায় নয়, ও যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে, নিজের মতো খেলাধুলা আর বেড়ানোতে মগ্ন থাকতে পারে। ডিসেম্বরের ছুটি শুধু বিশ্রাম নয়, ও যেন শিখে প্রকৃতি আর সম্পর্কের সৌন্দর্যও।শৈশবের সেই দিনগুলো হারিয়ে গেলেও স্মৃতিগুলো যেন আজও আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। ডিসেম্বর আমার কাছে কেবল একটি মাস নয়, এটি এক জীবন্ত অ্যালবাম, যেখানে আমি বারবার ফিরে যাই, যেন নিজের শেকড় খুঁজে পাই।