মোঃ জাহেদুল ইসলাম রতন, লালমিনরহাট: লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় এক পরিবারের নয়জন সদস্যের সাতজনেই প্রতিবন্ধী। তারমধ্যে পাঁচজন দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধী, একজন মানসিক ও একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী। দারিদ্র্যের চাপে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেলেও পরিবারটি ভিক্ষা করা দুরের কথা কারও কাছে হাতও পাতে না। জানা গেছে, উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের দীঘলটারী সানকার চওড়া গ্রামে দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধী এন্তাজুল হক (৬৫)। তিনি জম্মগত ভাবে দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধী কাজকর্মে অক্ষম তার স্ত্রী স্বাভাবিক নুরজাহান বেগম (৫৫)। বিয়ের পর থেকে সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম। এন্তাজুল-নুরজাহান দম্পতির সংসারে একে একে চার ছেলে ও এক মেয়ের জম্ম হয়। প্রথম ছেলে নুরন্নবী ইসলাম (২৬), দ্বিতীয় ছেলে নুর আলম (২৪), তৃতীয় ছেলে লিমন ইসলাম (২২) ও চতুর্থ মেয়ে রেশমা বেগম (১৩) তার বাবার মতোই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে জম্ম হয়। পঞ্চম ছেলে সুস্থ সবল সুমন ইসলাম (১২) জন্ম হয়। সাত সদস্যর একটি পরিবারের পাঁচজন প্রতিবন্ধী হলেও মা নুরজাহান বেগম ও ছোট ভাই সুমন ইসলাম স্বাভাবিক আছে। কিন্তু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নুরন্নবী ও নুর আলমের বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও কোনো সুস্থ মেয়ের পরিবার রাজি না হওয়ায় একজনকে মানসিক ও একজনকে শ্রবণ প্রতিবন্ধী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে সম্পন্ন করা হয়েছে। এনিয়ে তাদের পরিবারের সদস্য নয়জন হলেও প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাতজন। ইতিমধ্যে বড় দুই ছেলের ঘরে সুস্থ ও স্বাভাবিক নাতি-নাতনি পেয়েছেন। বড় ছেলের শ্বশুড়-শাশুড়িও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী।এন্তাজুল-নুরজাহান দম্পতির বিয়ের পর থেকে সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম নুরজাহান অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধী স্বামী ও পাঁচ সন্তানের দেখভাল সহ মুখে ভাত তুলে দিয়েছেন। একদিন অন্যর বাড়িতে কাজ না করলে পেটে ভাত জোটে না, উপোষ থাকতে হয়েছে অনেকদিন। বর্তমান বয়সের ভারে নাজুক নুরজাহান ঝিয়ের কাজে অক্ষম। সাত থেকে নয় সদস্যর পরিবারটিতে একমাত্র উপার্জনক্ষম বড় ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নুরন্নবী গান গেয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ করে থাকেন। আর গান গাইতে দোতারাই তার একমাত্র ভরসা। ছোট ভাই সুমন তার বড় ভাই নুরন্নবীকে বিভিন্ন হাটবাজারে নিয়ে যায়। পথ দেখাতে সাহায্য করে। দোতরা হাতে সুরেলা কণ্ঠে গ্রামগঞ্জের হাট-বাজারে গান করেন। এমনকি নিজের ও তার পরিবারে করুন চিত্র তুলে ধরেন তিনি। গানের বিনিময় সামান্য আয়-রোজকারের টাকা আর সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের তরফ থেকে ভাতা দিয়ে চলে সাতজন প্রতিবন্ধীর এই বড় সংসার। দারিদ্র্যের চাপে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেলেও পরিবারটি ভিক্ষা বা কারও কাছে হাত পাতে না। নুরন্নবী বলেন, ‘আমি জম্মের পর থেকে দুই চোখ দিয়ে কিছুই দেখছি না। আমি পড়াশোনা করতে না পারলেও দুর্গাপুর ইউনিয়নের উত্তর গোবধা গ্রামের ওস্তাদ কমল সরকারের কাছে সংগীতের তালিম নিয়েছি। দোতারা আর হারমোনিয়াম বাজাতে শিখেছি। কিন্তু আল্লাহ পাক আমাকে গানের গলা ভাল দিয়েছেন। পাশাপাশি সাত থেকে আট ধরনের শারীরিক কসরত শিখেছি। আমি সেগুলো প্রদর্শন করে মানুষের মনোরঞ্জন করি, বিনোদন দেই। তাঁরা খুশি হয়ে যৎসামান্য সম্মানী দেন। তাই দিয়ে নয়জনের সংসারের খরচ জোটে। তবু আমার পরিবারের কেউ ভিক্ষা করে না, মা নুরজাহান বলেন, প্রতিবন্ধী শিল্পী হিসেবে নুরন্নবীকে সবাই চেনেন। আমার বড় ছেলে নুরন্নবীর গানের গলা খুবেই ভালো। গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে দোতরা বাজিয়ে গান করেন। মানুষ গান শুনে খুশি হয়ে যা দেন তা দিয়ে চলে প্রতিবন্ধীর সংসার। আমিও আর আগের মতো অন্যর বাড়িতে কাজ করতে পারি না। ঝড় বৃষ্টি ও রোজার মাসে মানুষ গান শুনতে চায় না। সে সময়ে আমার খুব কষ্ট হয়। ধারদেনা করে চলতে হয়। সরকারের দেয়া প্রতিবন্ধী ভাতা টাকা দিয়ে সংসার চলে না। ধারের টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে প্রায়ই দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়। এ বিষয়ে আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) রওজাতুল জান্নাত বলেন, একই পরিবারে অনেক প্রতিবন্ধীর খবর আমার জানা নেই। খোঁজখবর নিয়ে ওই প্রতিবন্ধী পরিবার সরকারি ভাতা না পেলে ভাতার কার্ডের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।