মোঃ জাহেদুল ইসলাম রতন লালমিনরহাট: অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে লালমিনরহাটে জেঁকে বসেছে শীত। আমন ধান কাটা শেষ, নতুন ধানের চাল দিয়ে বাহারি পিঠা তৈরি করেছেন গ্রামীণ নারীরা। গ্রাম বাংলার ৪৯ পদের পিঠা নিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারও লালমনিরহাটের বড়বাড়ি শহীদ আবুল কাশেম ডিগ্রী কলেজ মাঠে দিনব্যাপী গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী জামাই-বউ মেলায়। এরআগে ১৬ ডিসেম্বর মেলার উদ্বোধন করেন বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু। এ মেলা আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। এবারের মেলায় মৎস্য স্টল, পিঠা স্টল ও অন্যান্য প্রসাধনী পণ্যের স্টল স্থান পেয়েছে। দিনব্যাপী চলে পিঠা খাওয়ার ধুম, বিভিন্ন গ্রামীণ নাটক, লোকনৃত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। উৎসবস্থলে গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেক এলাকায় আলাদা ও ভিন্ন ধরনের পিঠা রয়েছে এই মেলায়। আবার একই পিঠা এলাকা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। এমন কিছু পিঠা আছে যা সারাদেশেই প্রসিদ্ধ এবং জনপ্রিয়। এগুলো হচ্ছে রুটি পিঠা, গুরি পিঠা, ভাঁপা পিঠা, ঝাল পিঠা, ছাঁচ পিঠা, ছিটকা পিঠা, চিতই পিঠা, দুধ চিতই, চুটকি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চাঁদ পাকান পিঠা, ছিট পিঠা, পুলি পিঠা, পাতা পিঠা, পাটিসাপটা, পাকান পিঠা, পানতোয়া, মালপোয়া, মেরা পিঠা, মালাই পিঠা, মুঠি পিঠা, কুলশি, কাটা পিঠা, কলা পিঠা, খেজুরের পিঠা, ক্ষীর কুলি, গোকুল পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, ঝুরি পিঠা, ঝিনুক পিঠা, সূর্যমুখী পিঠা, নকশি পিঠা, নারকেল পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি, নারকেলের সেদ্ধ পুলি, নারকেল জেলাফি, তেজপাতা পিঠা, তেলের পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, দুধরাজ, ফুল ঝুরি পিঠা, ফুল পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, সেমাই পিঠা সহ নানান পদের দেশি পিঠা সাজিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলে। এদিকে মেলা উপলক্ষে লালমনিরহাট সদর উপজেলার চারটি ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এসেছেন মেয়ে ও জামাই। গলায় মালা ও লাল শাড়ি পড়ে নতুন রূপে সেজে-গুজে মেয়ে-জামাই এসেছে মেলায়। তারা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য কিনছে বড় মাছ ও নানান রকমের মিঠা। নতুন জামাই বাড়িতে আসবে বলে শ্বশুরদের ও কিনতে হচ্ছে বড় বড় মাছ। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত ও আশপাশের জেলা থেকে দর্শনার্থীরা মেলায় এসেছেন। মেলায় হরেক রকমের পিঠা ও নানা প্রজাতির মাছ নিয়ে দোকানিরা পসরা সাজিয়ে বসেছেন। মেলায় প্রতিদিন সকালে মৎস্য উৎসব ও বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলবে পিঠা উৎসব। তাই পিঠাপুলির স্বাদ নিতে দূরদূরান্ত থেকে ভিড় জমায় শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। মেলায় কথা হয় শেফালী বেগম নামের এক নারীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পিঠা উৎসব বাঙালির একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। পিঠা তৈরির সাধারণ উপাদান হচ্ছে চালের গুঁড়া, ময়দা, গুড় বা চিনি, নারিকেল ও তেল। অনেক সময় কিছু কিছু পিঠাতে মাংস ও সবজি ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও সবজি পুলি, সবজি ভাপা, ঝাল কিংবা মাংস পাটিসাপটা। কোনো কোনো সময় কাঁঠাল, তাল, নারিকেল, কলা ইত্যাদি ফল দিয়েও পিঠা বানানো হয়। পাতায় মুড়িয়ে এক ধরনের বিশেষ পিঠা তৈরি হয়। যাকে পাতা পিঠা বলা হয়। কিছু কিছু পিঠার আকার অনুযায়ী নামকরণ করা হয়। বড় ধরনের পিঠাকে হাঁড়ি পিঠা এবং ছোট আকৃতির পিঠাকে খেজুর পিঠা বলা হয়। এ বছরও আমরা হরেক রকম পিঠা এনেছি অতিথিদের খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে ও আনন্দ উপভোগ করার জন্য। মেলায় আগত দর্শনার্থীরা বলেন, এখানে বিভিন্ন রকম পিঠা দেখছি। এসব পিঠা আগে কখনো দেখিনি। আমরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে গ্রামবাংলার পিঠাগুলোর নাম ভুলে গেছি। ঘরে ঘরে তৈরি করা পিঠাগুলো এখানে এনে উৎসব করা হচ্ছে। বাঙালির কৃষ্টিকে ধরে রাখা এবং নতুন প্রজন্ম যাতে এই কৃষ্টিকে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। সে জন্যই এ আয়োজন। এ বিষয়ে মেলা আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ফারুক সিদ্দিকী বলেন, সব মিলিয়ে গ্রাম-বাংলার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতেই মূলত এ ব্যতিক্রমী মেলা।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে উৎসবের মাধ্যমে বাঙালির ঐতিহ্য সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে ধারণা দেওয়া সম্ভব। বাঙালি উদার, সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসবকে ধরে রাখতেই এই আয়োজন করা হয়েছে।