ওয়াহিদ মুরাদ, স্টাফ রিপোর্টার–ষড়ঋতুর দেশ এই বাংলাদেশ। কাল পরিক্রমায় প্রতিবছর ঘুরে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। ফাল্গুন ও চৈত্র এই দু’মাসব্যাপী চলা বসন্তেরও রাজত্ব শেষ হয় চৈত্রের অন্তিম দিনে- সেই সঙ্গে বয়ে নিয়ে আসে নতুন বাংলা বছরের সূচনালগ্নের আগাম বার্তা। পুরনো বছর ও জীর্ণতাকে বিদায় এবং নতুন বছর ও আশাকে বরণ করার উৎসব চৈত্র-সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ। নববর্ষের আগের দিন তথা পুরনো বছরের শেষ দিনে পালিত হয় চৈত্র সংক্রান্তি বা বর্ষ বিদায়। এই দিনটাকে সমগ্র বাঙালি উদযাপন করে নানা প্রকার বর্ণিল উৎসবের মাধ্যমে। এই উৎসব বাঙালির আদি সংস্কৃতি ও লোকাচারের অংশ। এটি এখন রূপ নিয়েছে বাঙালির জাতীয় উৎসবের একটিতে। পুরাতন ও জীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে নতুনত্বের বরণ এবং নতুন আশা, আকাঙ্খা, হাসি ও রঙের মণিকোঠায় পরিণত হয়েছে চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরণের সম্মিলিত উৎসব। চৈত্র সংক্রান্তি পালিত হয় ১৩ই এপ্রিল তথা বর্ষবরণের আগের দিন। বর্তমানে এই উৎসব তার ধর্মীয় গন্ডী পেরিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে দেশের মানুষের নিকট অন্যতম পার্বণ ও উৎসবের উপলক্ষ্য হিসেবে হাজির হয়েছে। পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে নতুন উদ্যমে নতুনভাবে সব শুরু করার এবং পূর্বের মঙ্গলময়তা ও সৌভাগ্যকে সামনে টেনে নিয়ে যাবার প্রণোদনা থেকেই বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ। চৈত্র সংক্রান্তিতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এদিনে দোকানপাট পরিষ্কার ও ধোয়া-মোছা করে অশুচি, জঞ্জাল ও অপবিত্রতাকে বিদায় জানায় এবং পরের দিন তথা নতুন বছরে সব নতুন করে শুরু করার প্রস্তুতি নেয়। নতুন বছরে নতুন হিসেবনিকেশ খোলার রীতি যা ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত, তার প্রস্তুতিও শুরু হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে। ধূপ-ধুনো এবং গোলাপ পানির সুবাসে মুখরিত হয় দোকান। ব্যবসায়িক সম্প্রদায় মূলত এ দিনটিকে বিদায় উৎসব হিসেবে পালন করে। পুরাতন বছরের বকেয়া টাকা উত্তোলনের দিন এটি কারণ পরদিন নতুন বছরে খোলা হবে নতুন খাতা, চলবে নতুন হিসেব। প্রাচীনকালে চৈত্র সংক্রান্তিতে গৃহস্থরা তাদের নাতি-নাতনী ও মেয়ে জামাইকে সাদরে নিমন্ত্রণ ও আপ্যায়ন করত। পরিবারের সকলকে নতুন কাপড় দেবার এবং উন্নতমানের ভোজন আয়োজনের চল ছিল। এছাড়াও বর্তমানে চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে নানান অনুষ্ঠান, মেলা, লাঠিখেলা, গান, নৃত্য, আবৃত্তি, শোভাযাত্রা, সঙযাত্রা, যাত্রা-পালা, মৃত্-কারু-পট শিল্প প্রদর্শনী প্রভৃতির আয়োজন করা হয়। বর্ষবিদায়ের বর্ণিল উৎসবে মেতে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। নানান ধরনের স্থানীয় পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে এসব মেলা। বাঁশ, বেত, কাঠের তৈরি আসবাবপত্র, মাটি, ধাতু, প্লাস্টিক, রাবার প্রভৃতির তৈরি জিনিস বেচাকেনা হয় এসব মেলায়। এছাড়াও থাকে সার্কাস, যাত্রাপালা, গান-বাজনা, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, ঘুড়ি ওড়ানোর মতো নানান বিনোদনের খোরাক। চৈত্র শেষের রঙে নিজেকে রাঙাতে বাদ যায় না বিশ্ববিদ্যালয় গুলিও। বর্ণিল ও বাহারি সাজে সেজে পুষ্পকন্যার ন্যায় সজীব হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলি। বাংলা বছরের শেষ উপলক্ষ্যে যেমন নানান সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় , তেমনি দেখা যায় মেলা, গ্রামীন খেলাধুলা, ঘোড়দৌড় ও বিভিন্ন আনন্দ আসরের। পাশাপাশি চলতে থাকে পরদিন নতুন বছরকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবার জোর প্রস্তুতি। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক সংগঠন সাক্ষর রাখে নিজস্ব পরিবেশনার। নকশা-আল্পনার লালিমায়, আনন্দ শোভাযাত্রা ও হালখাতার আগমনী আনন্দ সুবাসে সর্বত্র সাজ সাজ রব পড়ে যায়। আর এভাবেই পুরনোকে আনন্দের সাথে বিদেয় দিয়ে আমরা পা রাখি এক অবারিত নতুনের জগতে, নতুন আশা, উদ্যম আর প্রেরণার গালিচায়। এভাবেই গ্রাম ছাপিয়ে এখন শহরে ঠাঁই করে নিয়েছে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব। হাসিমুখে পুরাতনকে বিদেয় দিয়ে নতুন দিনের আগমনী বার্তায় মিশে যেতে প্রতি বছর উন্মুখ হয়ে ওঠে গ্রাম ও নগরবাসী। জাতি ও ধর্মগত ভেদ ভুলে আনন্দের শামিয়ানাতলে একীভূত হয়ে যায় নানান শেকড়ের মানুষ। মানুষ, আনন্দ, রং, উৎসব আর হৃদ্যতার অপূর্ব পরিস্ফুটন দেখা যায় বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের এই আনন্দযজ্ঞে।
Leave a Reply